মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে- নানা রঙে, নানা মাত্রায়। স্বপ্ন দেখার এই শক্তি একমাত্র মানুষের মাঝেই রয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এখানেই মানুষের পার্থক্য। প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলো মানুষ, যে নিজের মতো করে ভাবতে পারে, নিজের পছন্দমতো স্বপ্ন দেখতে পারে এবং তা বাস্তবায়নে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারে। তাই আগামী দিনগুলোতে যে পরিবর্তন আসবে, তার সঙ্গে মিলিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য এখন থেকেই আমাদের পথ পরিক্রমা সাজাতে হবে। সত্যিকার অর্থে আমাদের জন্য কোন পেশা অপেক্ষা করছে, তা আমরা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারব না। কারণ, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের (4IR-Fourth Industrial Revolution) সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। প্রযুক্তির কল্যাণে এবং গ্রিন পরিবেশ ও টেকসই অর্থনীতির প্রয়োজনে ভবিষ্যতে অনেক নতুন পেশা বা কর্মক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। এগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্র ও সুবিধা সম্পর্কে জানা এবং নিজেদের ভবিষ্যতের ক্যারিয়ারের জন্য প্রস্তুত করা আমাদের জন্য খুবই জরুরি। একটি সফল কর্মজীবনের পথ তৈরি করার জন্য এসব পরিবর্তন বিবেচনায় রেখে আমাদের যথাযথ পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিতে হবে।
আমরা প্রায় সবাই নাসার কথা শুনেছি। সৌরজগতের বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে মানুষের জল্পনা কল্পনার সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর ঘাঁটি হচ্ছে নাসা (NASA-National Aeronautics and Space Administration) | এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্বাধীন সংস্থা, যা বিমানচালনাবিদ্যা ও সৌরজগৎ সম্পর্কিত গবেষণা করে থাকে। আজ নাসার একজন বিজ্ঞানীর গল্প শুনব।
বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে ওঠে শাহনাজ। ছোটোবেলায় খেলাধুলায় মনোযোগী ছিলেন। আঁকাআঁকি করতেও বেশ পছন্দ করতেন। কিন্তু রাতের আকাশ দেখা ছিল তার প্রিয় কাজের একটি। মাধ্যমিকে পড়ার সময় সায়েন্স ফিকশন ও পদার্থবিদ্যায় তৈরি হয় তার প্রবল আগ্রহ। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে তাই ভর্তি হন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি) সংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন শাহনাজ এবং তার সঙ্গে পড়ুয়া আরও অনেকে। পরপর তিনবার অংশগ্রহণ করেও তাদের টিমের পুরস্কার পাওয়া আর হয়ে ওঠে না। কিন্তু তাতে নিজের ওপর আস্থা হারাননি শাহনাজ। হতাশাকেও ঠাঁই দেননি মনের কোণে; বরং একেকটি হার যেন তার জন্য একেকটি অনুপ্রেরণা। প্রতিটি প্রতিযোগিতার পর সবাই মিলে নিজেদের ঘাটতি আর কী কী ভুল ছিল, কীভাবে ভুলগুলো শুধরানো যায়, প্রজেক্টের কী কী চ্যালেঞ্জ ছিল ইত্যাদি খুঁজে বের করেন এবং এরপর নতুনভাবে প্রজেক্ট তৈরির পরিকল্পনা করেন।
মহাজাগতিক রেডিয়েশন মহাকাশে আলোর গতিতে চলা উচ্চশক্তির প্রোটন এবং পারমাণবিক নিউক্লিয়াস থেকে সৃষ্ট বিকিরণে প্রভাবে সৃষ্ট একধরনের পরিস্থিতির কবল থেকে রক্ষা করার জন্য তাঁরা মহাকাশচারীদের জন্য তৈরি করেন এক বিশেষ পোশাক। তাঁদের এই প্রজেক্ট পরবর্তী সময়ে বিশ্বের অনেক দেশকে হারিয়ে প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতে নেয়। এরপর তিনি অ্যাস্ট্রোফিজিকসে মহাশূন্য, শক্তির বিকিরণ, কৃষ্ণগহ্বর ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা পড়াশোনার জন্য বৃত্তি (স্কলারশিপ) পেয়ে বিদেশের মাটিতে শুরু করেন তার গবেষণা জীবন। গবেষণাকালেই তিনি টেক্সাসের হিউস্টনে অবস্থিত নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করেন। দক্ষতা ও কাজের প্রতি একাগ্রতা তাকে নাসায় কাজ করার অনন্য সুযোগ এনে দেয়। বর্তমানে শাহনাজ নাসায় একজন বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছেন, যা ছিল তাঁর একসময়কার স্বপ্ন! ছোটোবেলা থেকেই সায়েন্স ফিকশন এবং বিজ্ঞান চর্চায় অনুরক্ত শাহনাজের কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবের পৃথিবীকে জানার যে যাত্রা, তা ছিল অসাধারণ। শাহনাজ এখন দীক্ষিত হয়েছেন নাসায় প্রচলিত 'এখানে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই' এই মন্ত্রে।
সাধারণভাবে বলা যায়, জীবনের সুনির্দিষ্ট কর্মময় অংশই হলো ক্যারিয়ার। সারা জীবন একজন মানুষ তার পেশা-সংক্রান্ত যেসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন, তা-ই হলো তার ক্যারিয়ার। কারিয়ার স্থির কিছু নয়, বরং পরিবর্তনশীল ও বিকাশমান। সবাই কামনা করেন, তার ক্যারিয়ারের এই পরিবর্তন বা বিকাশ যেন নিজের সাজানো লক্ষ্য অনুযায়ী হয়। ক্যারিয়ার সুন্দরভাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সবাইকে বিশেষ কিছু দিক লক্ষ রাখতে হয়:
ক) নিজের দক্ষতা এবং আগ্রহ ভালোভাবে জেনে নেওয়া: যেকোনো ব্যক্তির ক্যারিয়ার গঠনের ক্ষেত্রে নিজেকে জানা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই আমরা ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে 'কাজের মাঝে আনন্দ', 'কী আছে আমার মাঝে', 'আমার জীবন আমার লক্ষ্য' ইত্যাদি অভিজ্ঞতায় বিভিন্ন মজার কাজের (অ্যাক্টিভিটি) মধ্য দিয়ে নিজেকে জানার প্রচেষ্টা চালিয়েছি। নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, কাজের প্রতি আগ্রহ, মনোযোগ, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ ইত্যাদির পাশাপাশি নিজের দক্ষতা আছে কি না, সে বিষয়টিও ক্যারিয়ারের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখে। আমরা সাধারণত যেসব কাজ করতে ভালোবাসি, তা যদি জীবনের অধিকাংশ সময় ধরে করি, তাহলে সেই কাজ বা ক্যারিয়ার নিশ্চয়ই আনন্দময় হয়ে উঠবে।
খ) বিভিন্ন ধরনের পেশা সম্পর্কে ভালোভাবে জানা: নিজের পছন্দ বা দক্ষতা অনুযায়ী আমরা যা করতে চাই, তা খুঁজে বের করতে হবে। এ কাজটি করার জন্য আমাদের বিভিন্ন ধরনের পেশা, বৃত্তি, কাজ বা চাকরি সম্পর্কে অবশ্যই জানতে হবে। কোন ধরনের পেশার কাজ কী, সেগুলোতে কী ধরনের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হয়, তা জানার চেষ্টা করতে হবে। এগুলো জানা থাকলে নিজের কাজের ক্ষেত্র নির্বাচন করা বা খুঁজে বের করা সহজ হবে।
গ) লক্ষ্য নির্ধারণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন: ক্যারিয়ারের গতি বা বিকাশ চলমান রাখার জন্য এবং সফল ক্যারিয়ার গঠনের ক্ষেত্রে লক্ষ্য নির্ধারণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা অপরিহার্য। লক্ষ্য বা গন্তব্য স্থির করা না থাকলে অনেক সময় দেখা যায়, নিজের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সফল ক্যারিয়ার গঠন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। লক্ষ্য নির্বাচন করা হলে সেই অনুযায়ী কোন পর্যায়ে কী কী কাজ করতে হবে, কী ধরনের দক্ষতা অর্জন করতে হবে, কোন ধরনের প্রশিক্ষণ কখন করতে হবে ইত্যাদি বিষয়ক পরিকল্পনা করা সম্ভব হয়। এজন্যই ধাপে ধাপে পরিকল্পনা করার কৌশল আমরা পূর্বের শ্রেণিতে অনুশীলন করেছি।
ঘ) সংশ্লিষ্ট চাকরি বা কাজের ক্ষেত্র অনুসন্ধান করা: বিভিন্ন গণমাধ্যম, পত্রপত্রিকায়, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের চাকরির খোঁজ পাওয়া যায়। ক্যারিয়ার গঠনে এসব খোঁজ রাখা বা অনুসন্ধান করা খুব জরুরি। তবে এক্ষেত্রে অনেক যাচাই-বাছাই করার প্রয়োজন। নিজের জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কি না, বা এটি করার আগ্রহ আছে কি না এবং পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা আছে কি না- এই বিষয়গুলো ধৈর্য সহকারে খুঁজে দেখতে হবে।
ঙ) সময়ের চাহিদা অনুযায়ী কাজের ক্ষেত্র বা চাকরি পরিবর্তন: ক্যারিয়ারের এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। আমরা জানি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজের ধরন ও চাকরির ক্ষেত্র বদলায়। সুতরাং সময়ের চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে নিজেকে হালনাগাদ রাখা এবং প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করা খুব জরুরি। এ কারণে ক্যারিয়ারকে আরও সুগঠিত ও সাফল্যময় করার জন্য সময় ও সুযোগ অনুযায়ী কাজের ক্ষেত্র পরিবর্তন করতে হয়। নিজের নতুন অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আরও সুবিধাজনক চাকরি খুঁজে বের করা আমাদের ক্যারিয়ারের অগ্রযাত্রারই একটি অংশ।
মনোবিজ্ঞানী ডোনাল্ড সুপার আমাদের ক্যারিয়ার জীবনের বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে একটি মডেল দাঁড় করিয়েছেন, যা life rainbow নামে পরিচিত। এখানে সময়ের সঙ্গে মানুষের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যে পরিবর্তন ও স্থিতি দেখা যায়, তা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
ক্যারিয়ার নির্বাচনের জন্য বিদ্যমান পেশা, কাজের ক্ষেত্র এবং ভবিষ্যতে এসব পেশা ও কাজের ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন ও রূপান্তর আসতে পারে সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার। বিভিন্ন খাতের পেশা সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে কিছু তথ্য জেনেছি; এখন আমরা আগামীর সম্ভাব্য পেশা সম্পর্কে আরও জানার চেষ্টা করব। আমরা ফার্নিচার শিল্পে একসময় কাঠ রানদা করতে দেখেছি। কাঠমিস্ত্রি অনেক কষ্ট করে হাতে রানদা টেনে কাঠ পলিশ করতেন। আর এখন এসেছে কাঠ ফিনিশিং মেশিন বা উড প্ল্যানার মেশিন। যার ফলে অল্প সময়ে মেশিনে অনেক বেশি কাঠ পলিশ করা যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে এরকম হাজারো প্রযুক্তির আগমন সব পেশাতেই নিয়ে এসেছে যুগান্তকারী রূপান্তর।
মজার বিষয় হলো, কোন পেশাগুলো পূর্বে ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে; আবার কোনগুলো বিলুপ্ত হতে পারে, তা নিয়ে আমাদের দেশে একটি গবেষণা হয়েছে, সেখানে পেশার অতীত, বর্তমান এবং রূপবদল নিয়ে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে। গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল, ফার্নিচার, এগ্রো প্রসেসিং, লেদার এবং ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি- এই পাঁচটি সেক্টরে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। সেখানে দেখানো হয়েছে। গার্মেন্টস এবং ফার্নিচার সেক্টরে শতকরা ৬০ ভাগ পেশা (বর্তমানে চলমান) ঝুঁকির মধ্যে আছে। পাশাপাশি এগ্রো ৪০ ভাগ, লেদার ৩৫ ভাগ এবং ট্যুরিজম ও হসপিটালিটির ক্ষেত্রে ২০ ভাগ পেশা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই পেশাগুলোর কিছু আংশিক বদলে যাবে, কিছু রূপ বদল হবে, আবার কিছু একবারে বন্ধ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্টের দিকে তাকালে দেখতে পাই, জিডিপিতে শিল্প ও পরিষেবার সম্মিলিত অবদান ৮৮ শতাংশ, যেখানে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের অবদান রয়েছে। জীবন ও জীবিকার দিক থেকে অনানুষ্ঠানিক শ্রমবাজার বলতে ব্যক্তি উদ্যোগে কোনো কাজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা চাকরির এক অর্থনৈতিক খাতকে বোঝায়, যা সরকার বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বা সুরক্ষিত নয়। যেমন: নিজের জমি, দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ, গৃহস্থালি কাজ, হকারি, দিনমজুরি প্রভৃতি।
অন্যদিকে আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজার হলো অনেকটা নিয়ন্ত্রিত ও সুরক্ষিত, যেখানে সময় ও শ্রম পরিমাপের ভিত্তিতে আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা নিয়ন্ত্রিত হয়। আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে কাজের নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ, মজুরি, উৎপাদনশীলতা ইত্যাদি অনেকাংশে নির্ধারিত থাকে। আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ যেমন: উন্নয়ন পরিকল্পনা, কর্মপরিকল্পনা, ভর্তুকি ইত্যাদি থাকে। আবার অনানুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে সরাসরি এ ধরনের উদ্যোগ না থাকলেও বিশেষ প্রয়োজনে নেওয়া হয়ে থাকে। যেমন: করোনার সময়ে আমরা দেখেছি, সরকার কৃষকদের বিশেষ ভর্তুকি দিয়েছে।
কিন্তু এই শ্রমবাজার কয়েক বছর ধরে ব্যাপক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, স্কিলস গ্যাপ, অফিস অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, গিগ ইকোনমি ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সমন্বয় ইত্যাদি কারণে এই শ্রমবাজারে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। শ্রমবাজারে অদূর ভবিষ্যতে আরও বেশ কিছু পরিবর্তন আসবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। যেমন:
অটোমেশন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্রুত অগ্রগতি শ্রমবাজারে প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে। দৈনন্দিন জীবনের রুটিন কাজ, বারবার করতে হয় এমন কাজ যন্ত্রনির্ভর বা স্বয়ংক্রিয় হয়ে যেতে পারে, যা নির্দিষ্ট শিল্পে শ্রমবাজারে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে। নতুন যে সুযোগ তৈরি হবে, তা হলো রোবোটিকস ইঞ্জিনিয়ার, এআই ডেভেলপার এবং ডেটা বিশ্লেষণের মতো ক্ষেত্র।
প্রত্যাশা করা হচ্ছে অটোমেশন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্রই দক্ষতার চাহিদার পরিবর্তন হবে। শ্রমবাজার ক্রমবর্ধমানভাবে নতুন দক্ষতা এবং ইনোভেশনকে সমর্থন জানাবে। বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাভাবনা, সমস্যা সমাধান, সৃজনশীলতা, মানসিক বুদ্ধিমত্তা এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা শ্রমবাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
মুক্তবাজার অর্থনীতির অন্য একটি বিশেষ দিক হলো গিগ ইকোনমি। এর ফলে পূর্ণসময় কাজের পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদি চুক্তি এবং স্বাধীনভাবে ফ্রিল্যান্সারদের কাজের বাজার প্রসারিত হচ্ছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে যেকোনো জায়গায় বসে কাজ করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ শ্রমবাজারে নতুন মাত্রা ও চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
আমরা দেখছি, শ্রমবাজার মেরুকরণের সম্মুখীন হচ্ছে, যার অর্থ হলো উচ্চ-দক্ষতা এবং নিম্ন-দক্ষতার প্রাধান্য পাচ্ছে শ্রমবাজারে। কাজগুলো দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ছে, পাশাপাশি মধ্যম দক্ষতার শ্রমবাজার হ্রাস পাচ্ছে। উচ্চ-দক্ষ কাজের ক্ষেত্রের জন্য উচ্চশিক্ষা এবং বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অদক্ষ বা কম দক্ষতার কাজগুলো অটোমেশনের প্রতিযোগিতার কারণে হারিয়ে যেতে পারে।
এসডিজির উন্নয়নে শ্রমবাজার এখন গ্রিন জব এবং টেকসইকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা, কাজের স্থায়িত্ব, সবুজ অর্থনীতি, নবায়নযোগ্য শক্তি, পরিবেশ সংরক্ষণ, টেকসই কৃষি এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে কাজের সুযোগ তৈরি হবে আগামীর শ্রমবাজারে।
পৃথিবীর অনেক দেশই বার্ধক্যজনিত শ্রমশক্তির সম্মুখীন হচ্ছে, যা আগামীর শ্রমবাজারকে প্রভাবিত করবে। এসব দেশের বয়স্ক জনসংখ্যার জন্য পেশাগত স্বাস্থ্যসেবা, কেয়ারগিভিং এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সহায়তার জন্য দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের প্রয়োজন হবে। ফলে এ ধরনের শ্রমবাজারের জন্য দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমশক্তি তৈরির উদ্যোগ জরুরি।
গ্লোবালাইজেশন এবং ডিজিটালাইজেশন শ্রমবাজারে নতুন রূপ আসছে। কোম্পানিগুলো ক্রমেই ডিজিটাইজ হচ্ছে, ভৌগোলিক সীমারেখা অতিক্রম করছে, সৃজনশীল ও দক্ষ কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিচ্ছে এবং আমরা একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হচ্ছি। তাই বলা যায়, এই প্রবণতা বিশ্ব প্রতিযোগিতাকে তীব্র করে তুলতে পারে এবং বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমশক্তিই আগামীর শ্রমবাজারে টিকে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অভিযোজনযোগ্যতা, ক্রমাগত দক্ষতার বিকাশ, নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ ও উদ্ভাবন আগামীর শ্রমবাজারে প্রভাব বিস্তার করবে।
বাংলাদেশের জাতীয় শ্রমবাজার বিভিন্ন খাত নিয়ে গঠিত যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বিপুল সংখ্যক কর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ কৃষি, সেবা, শিল্প ইত্যাদি খাতে রয়েছে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, 4IR প্রযুক্তি কর্মদক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে দেবে, যা শ্রমবাজারকে পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাবে। এই পরিবর্তনগুলো নেভিগেট করার জন্য ডিজিটাল দক্ষতায় আপস্কিলিং এবং রিস্কিলিং করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু চাকরি নয়, উদ্যোক্তার মানসিকতা গড়ে তোলা এবং উদ্ভাবনী চর্চা নতুন সুযোগ তৈরি করবে। পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব (4IR), শিল্পে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের শ্রমবাজার এবং শ্রমের চাহিদার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে। এখন আমরা আমাদের বিভিন্ন খাতে সম্ভাব্য প্রভাব (প্রজেকশন) কেমন হতে পারে, তার সঙ্গে সংক্ষিপ্তভাবে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করব।
বাংলাদেশের শ্রমবাজারে কৃষির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এ খাতে জনসংখ্যার একটি বড় অংশের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। শস্য চাষ, পশুপালন, মৎস্য চাষ এবং কৃষি প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি খাতে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ রযেছে। এই খাতে নতুন জাতের উন্নয়ন, শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা, আয় বৃদ্ধি, অবকাঠামো এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ রয়েছে। স্বল্প খরচ বা বিনিয়োগের পেশা হিসেবে কৃষিতে কিছু নতুন সম্ভাবনাও তৈরি হতে যাচ্ছে। 4IR প্রযুক্তি প্রসারের ফলে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাবে, ফসল-পরবর্তী ক্ষতি কমে আসবে এবং সম্পদের ব্যবহার সুনির্দিষ্ট হবে। প্রযুক্তি উন্নত জাত, IoT সেন্সর স্প্রে ও বালাইনাশক, ডেটা বিশ্লেষণ, ফসল পর্যবেক্ষণ, সেচ ব্যবস্থা এবং ফসল সংগ্রহ ব্যবস্থাপনাকে সমৃদ্ধ করবে। ফলে কৃষিপ্রযুক্তি এবং তথ্য বিশ্লেষণে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা যেমন বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, অন্যদিকে কায়িক শ্রমের চাহিদা কমতে পারে। এছাড়া বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন উদ্ভূত ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায়ে বৃক্ষরোপণ, অর্গানিক ফসল উৎপাদনে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে নার্সারি স্থাপন, নতুন প্রজাতি উদ্ভাবনের প্রযুক্তি, অর্নামেন্টাল ট্রি, ফিশ চাষ ইত্যাদির ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে।
গার্মেন্টস এবং টেক্সটাইল শিল্প বাংলাদেশের শ্রমবাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত, যেখানে শ্রমশক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী পোশাক রপ্তানিকারকদের মধ্যে অন্যতম এবং রপ্তানি আয়ের একটি বড় অংশ (প্রায় ৮২ ভাগ) এ খাত থেকে আসে। এখানে গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিং, স্টিচিং, কোয়ালিটি কন্ট্রোল এবং ম্যানেজমেন্টসহ বিভিন্ন পেশায় কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। 4IR প্রযুক্তি যেমন: অটোমেশন, রোবোটিকস এবং ডেটা অ্যানালিটিকস গার্মেন্টস এবং টেক্সটাইল শিল্পে বিপ্লব ঘটানোর সম্ভাবনা রয়েছে। অটোমেশন প্রোডাকশন অনেক গুণ বাড়িয়ে দেবে এবং শ্রম-নির্ভর কাজের ওপর নির্ভরতা কমাতে পারে। আবার প্রযুক্তি, প্রোগ্রামিং এবং ডেটা বিশ্লেষণে দক্ষ শ্রমিকদের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্বল্প-দক্ষ কর্মীদের চাহিদা হ্রাস পেতে পারে। কিন্তু অটোমেশনের কারণে এই খাতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে যাচ্ছে অদক্ষ এবং অল্প দক্ষ শ্রমিকদের নিয়ে, তাঁদের চাকরি হারানোর উদ্বিগ্নতা দিন দিন বাড়ছে। ফলে আমাদের এই শিল্পে আগতদের সম্ভাব্য দক্ষতা অর্জন করা জরুরি।